ঢাকার নাইট-ক্লাব ও ডিজে-পার্টিতে অসভ্যতা? প্রশাসন কেন নীরব?

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। পৃথিবীর অন্যতম জনবহুল শহর যেখানে দুই কোটিরও অধিক মানুষের বাস; বড় বড় অট্টালিকায় ছেয়ে যাওয়া এই মেগাসিটিতে রয়েছে নানা পদের মানুষ, ধনী গরীবের অসামঞ্জস্যতা! ধনীর মার্সিডিজ নিয়ে ছুটে যাওয়া, অন্যদিকে অভুক্তের পেটে খিদের চিৎকার। রয়েছে অস্ত্রধারী মানুষের সমাহার যারা একটা নির্দেশ আর কিছু টাকার জন্যে আরেকটা প্রাণ শেষ করে দিতে সময় নেয় না। রয়েছে প্রেম, রয়েছে ভালোবাসা। সারাদিন পর অফিস থেকে ফিরে এসে স্বামী-স্ত্রীর একসাথে ডিনার, অন্যদিকে রিকশাওয়ালার সারাদিনের ঘামে ভেজানো টাকা দিয়ে একটু শাক আর লাউ নিয়ে বাড়ি ফিরে বউকে বলা, “বউ শোন, আইজকে রাইতে ভালোমন্দ খামু, তারপর তোরে রিকশায় বসাইয়া রাইতের ঢাকায় রিকশা চালামু”

এমন প্রেম ভালোবাসার সাথে সাথে আরো অনেক কিছুই রয়েছে যা যোগ হয়েছে এই ঢাকা শহরে যা দশ থেকে পনেরো বছর আগেও ছিল না। রাতের ঢাকা যেন এক রহস্যময় জগত। যে রহস্য উদঘাটন করার মত নয়। রাত একটু ১২টা কাটার আশেপাশে গেলেই ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলোতে শুরু হয় উচ্চ-মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলে মেয়েদের বিচরণ। এই বিচরণ কিছু নির্দিষ্ট স্থানে। আপনারা এই লেখার টাইটেল দেখে ইতিমধ্যে জেনে গিয়েছেন, কোথায় তাদের যাতায়াত। কিংবা লেখার সাথের ফিচার ফটো দেখে হয়তো অনেকেই ভাবছেন, এ আর নতুন কি? এই ফিচার ফটোর প্রতিটা ছবি বাংলাদেশের বিভিন্ন নৈশ ক্লাবের। কোন বিদেশী নাইট ক্লাবের ফটো এনে জুড়ে দেয়া হয়নি।

আসলেই তাই, এটা বর্তমানে ঢাকা শহরে একদম নতুন কিছু নয়। কারণ, আগে এইসব নাইট ক্লাব চলতো নামী দামী হোটেলে বিদেশীদের জন্য। বাইরে কিছু থাকলেও তা গোপনে পরিচালিত হতো। কিন্তু সেদিন বহু আগেই হারিয়ে গেছে। দিন বদলেছে। এখন আমরা ক্যাফে হাউজে বসে কফি হাউজের সেই আড্ডাটা গানটা শুনিনা। এখন শুনি বিদেশী ছবির অর্ধ নগ্ন নাচের সাথে থাকা গান কিংবা সানি সানি সানি , পানি পানি পানি টাইপের গান।

যাইহোক, যা বলছিলাম আরকি! ঢাকায় জমে উঠেছে নাইট ক্লাব আর ডিজে পার্টি কিংবা ডিসকো পার্টির রমরমা ব্যবসা আর আসর। আর এর নিয়মিত কাষ্টমার হলো উচ্চবিত্ত ঘরের যুবক-যুবতীরা। পশ্চিমা সংস্কৃতির ঢেউ লেগেছে আর এই উথাল পাথাল ঢেউয়ে ভেসে যাচ্ছে আমাদের যুব সমাজের একটা অংশ। পশ্চিমা দেশ তথা ইউরোপে থেকে জেনেছি নাইট ক্লাব কি, কিন্তু শুধু দেখতে যাওয়া ছিল সেটা , সেখানে কি চলে এই আরকি! আমার অনেক বন্ধু যারা ঢাকা শহরে থাকে, তারাও এইসব নাইট ক্লাবে যেতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। সেগুলো ঠিক এই পাশ্চাত্যের দেশগুলোরই নকল করে তৈরী করা। সব ব্রান্ডের মদ, ওয়াইন, সিগারেট, সিগার, হুইস্কি কি নেই সেখানে? শুধু টাকা দরকার সেখানে যেতে। ক্লাবের মেম্বারশীপ পেয়ে গেলে তো কথায় নেই!! হিন্দি গানের তালে তালে যুবক-যুবতীরা উদ্যম নেচে মেতে ওঠে। নারীরা মদ্যপ অবস্থায় নিজেকে বিকিয়ে দিতে দ্বিধাবোধ করেনা। বাংলাদেশেরই কিছু টেলিভিশন চ্যানেলের অনুসন্ধানী খবরে উঠে এসেছে আরো কিছু তথ্য। শুধু বড়লোক ঘরের দুলাল-দুলালীরাই নয়, এখানে আসর বসে নৈশ-পরীদেরও। যারা কিনা খদ্দের পাওয়ার আশায় এসব নাইট ক্লাবে আসা যাওয়া করে। তবে ব্যক্তিগত ভাবে আমার মনে হয়, এই নৈশ-পরী আর ধনীর দুলালির ভেতরে কোন পার্থক্য নেই। কি ভাবছেন? আমি শুধু একপেশে বিচার করছি? পুরুষ বলে কি পুরুষের কথা বলবো না? লিখবো না ভাবছেন? আরে ভাই, এই সব পার্টিতে চলে গাঁজা, ফেনসিডিল, হেরোইন সেবন। মারিজুয়ানাও নাকি আসে, বাহ! কি উন্নতিরে বাবা! বিদেশী মদ আসে কোথা থেকে? কারা আনে? একটা সিন্ডিকেট এইগুলা সরবরাহে কাজ করছে। নাম বলবো না, অনেক প্রভাবশালী রাজনৈতিক কর্তাদের ছেলেরা এই সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছে।

আর সবচাইতে বড় বাবার নাম না বললেই তো নয়। ইয়াবা। এই ইয়াবা সেবন একটি ট্রেন্ডে হিসেবে চালু হয়ে গেছে। এটির সেবনকারীরা মনে করে এটি গ্রহণে সুন্দর আর আকর্ষণীয় হওয়া যায় , যৌনশক্তি বাড়ে, সেক্সি লুক আসে চোখে মুখে। আদতে তা কখনোই নয়। বরং এটি যেকোন মানুষের ভেতরের অংশ নিঃশেষ করে ফেলতে বেশিদিন সময় নেয় না। পুরুষ হারিয়ে ফেলে তার পৌরষত্ব আর নারী হারায় তার স্বাভাবিক মাতৃত্ব। ইয়াবার ভয়ংকর ছোবল যুবসমাজকে ধংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে। বিদেশী মদ আর দেশী মদ যাই হোক না কেন- ক্ষতি করছে লিভারকে। ভাসমান পতিতাদের ব্যবসা জমে উঠেছে। পুরুষ সেই জোয়ারে গা ভাসাচ্ছে, এইডস বাধাঁচ্ছে নিজের শরীরে। একাকীত্বতায় পেয়ে বসা মহিলা কিংবা বড়লোক ডিভোর্সী নারী থেকে শুরু করে নামীদামী কর্পোরেট কোম্পানীর মহিলারা দ্বারস্থ হচ্ছে পুরুষ এসকর্টদের। তাদের শুধু আনন্দ চায়, সময় কাটানোর সঙ্গী চায়; বিনিময়ে আছে টাকার বান্ডিল। বেকার পুরুষের একটা অংশ এখন এই পেশায় এসেছে , নারীদের সাথে সমানে পাল্লা দিচ্ছে। এক রাতেই যদি ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা আসে একটু সুখ দেবার বদৌলতে তবে সেটা খারাপ কি? ডিজে পার্টিতে ডিজে যারা আসে, তারা ম্যাক্সিমাম নারী ডিজে। এরাও এদেরই একটা অংশ।

এখন প্রশ্ন হলো, কি এই যুবক-যুবতীদের ভবিষ্যৎ? কি ভবিষ্যৎ এই বাংলাদেশের? কোথায় এর শেষ? কি করছে প্রশাসন?

যুবক-যুবতীদের ভবিষ্যৎ এর কথা চিন্তা করতে হবে প্রথমত বাবা-মা কে। বাবা-মা যদি তাদের সন্তাদেরকে অঢেল টাকা পয়সা দিয়ে রেখে দেয়, যা খুশি তাই করতে দেয়, কোথায় যাচ্ছে কি করছে এই সব খোঁজ-খবর না নেয়, তাহলে তো তারা বখে যাবেই। সন্তানের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রেখে দেখেন , বোঝেন তারা কি করে, আসলেই তারা কি চাই।

বন্ধু নির্বাচন আরেকটি বড় কথা এখানে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, খারাপ বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে ছেলে মেয়ে বখে যায়।

মেডিক্যাল সায়েন্স অনুযায়ী এসকল নেশায় নেশাগ্রস্ত হলে সেই মানুষ বেশিদিন বাচেঁ না। বিশেষ করে ইয়াবাতে বর্তমানে সবাই ঝুকঁছে। আর অনিরাপদ শারীরিক সম্পর্কের ফলে সহজেই এরা এইডস রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

প্রশাসনের দিক থেকে এই সকল ব্যাপারে এখন পর্যন্ত ইতিবাচক তেমন কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। মূলত এসব নৈশ ক্লাবের লাইসেন্স থাকলে যেসকল মদ বা নেশার দ্রব্য এখানে সরবরাহ করা হয়, তা সম্পূর্ণ আইনত দন্ডনীয়। পুলিশ এসব জেনেও চুপ করে আছে। ভেজাল দ্রব্য নিধনে ম্যাজিষ্ট্রেট যেমন ভ্রাম্যমাণ আদলত নিয়ে রাস্তায় বের হন, তেমনি রাতের ঢাকাতেও তাদের এমন অভিযান চালানো উচিত। তাতে করে যদি এই নেশার কবল থেকে যুব সমাজ কে রক্ষা করা যায়! অনেক নৈশ ক্লাব আবার নকল বা ভুয়া কিংবা কোনো লাইসেন্স ছাড়াই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক প্রভাব এখানে মূখ্য হিসেবে কাজ করে থাকে। এসব নৈশ ক্লাব থেকে শুরু হয় নানা প্রকার জের বিরোধ যা নিয়ে খুনোখুনি পর্যন্তও গড়ায়।

সবশেষে , একটা কথায় বলবো, সরকার বা প্রশাসন যদি পদক্ষেপ না নেয়, এসব ব্যাঙের ছাতার মত গড়ে ওঠা নৈশ ক্লাব বন্ধ করতে, তবে সেটার প্রভাব গিয়ে পড়বে এই দেশের সকল স্তরে।  কেননা, আজকের সুস্থ কিশোর-কিশোরী , যুবসমাজই আগামীর ভবিষৎ, আগামীর নেতা, দেশের সম্পদ।

তাই, প্রশাসনের কারো যদি এই লেখা চোখে পড়ে থাকে, তবে অনুরোধ রইলো, জরুরী পদক্ষেপ নিয়ে এইসব নৈশ ক্লাব বন্ধ করে, মাদক অভিযান শুরু করে যুবসমাজকে ধংসের হাত থেকে রক্ষা করতে।

সমাপ্ত

কপিরাইট বিজ্ঞপ্তি

এই সাইটের সকল স্বত্ত্ব শুধুমাত্র লেখক ফেরদৌস সাগরের। গল্প সমূহের যে কোনো অংশ কপি করা থেকে বিরত থাকতে অনুরোধ করা হচ্ছে। সকলকে শুভকামনা ও ভালোবাসা।